রেলওয়ের একটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গত সোমবার গ্রেপ্তার হওয়া ১৭ জনের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) কর্মকর্তা-কর্মচারী ছয়জন। এর মধ্যে পাঁচজন এখনো কর্মরত। আরেকজনকে ১০ বছর আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল।
যে পাঁচজন এখন কর্মরত রয়েছেন, তাঁদের সবার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে তিনজনের ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছিল পিএসসি। যে কারণে একজনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। একজনকে ঢাকার প্রধান কার্যালয় থেকে সিলেটে বদলি করা হয়। আরেকজনকে বরখাস্ত করা হলেও আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি দায়িত্ব ফিরে পান।
প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িতদের মধ্যে পিএসসির বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী ছয়জন।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া সাংবিধানিক সংস্থা পিএসসির বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছেন উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম। আরও আছেন সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, কর্মচারী (ডেসপাচ রাইডার) মো. খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম। এ ছাড়া রয়েছেন পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী।
আরও পড়ুন
এই ছয়জনের মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার বিষয়টি পিএসসির নিজস্ব তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালে চাকরিচ্যুত হন সৈয়দ আবেদ আলী। বরখাস্ত হয়েছিলেন খলিলুর রহমান। বদলি করা হয়েছিল জাহাঙ্গীর আলমকে। আর পদোন্নতির জন্য বিবেচনা করা হয়নি আবু জাফরকে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পিএসসির যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম এসেছে, দেখা যাচ্ছে তাঁরা আগেও এ ধরনের গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন সময় পিএসসির নিজস্ব অনুসন্ধান ও তদন্তেই তা বেরিয়ে এসেছে। পিএসসির ভেতরেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটি চক্র কাজ করছে। এর মধ্যে কেউ ধরা পড়েছেন, কেউ এখনো আড়ালে রয়ে গেছেন। বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক সংস্থা পিএসসি কেন ফৌজদারি মামলা করেনি, সেই প্রশ্নও তুলেছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় অপরাধ স্বীকার করে গতকাল মঙ্গলবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন ছয়জন। এর মধ্যে পিএসসির সাবেক ও বর্তমান কর্মচারীই তিনজন। তাঁরা হলেন সৈয়দ আবেদ আলী, খলিলুর রহমান ও সাজেদুল ইসলাম।
আরও পড়ুন
গ্রেপ্তার হওয়া ১৭ জনের বিষয়ে আদালতে জমা দেওয়া সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামিরা ৫ জুলাই পিএসসির অধীনে নেওয়া বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী (নন–ক্যাডার) পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। নিয়োগ প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করেছেন তাঁরা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা স্বীকার করেছেন, বিগত বছরগুলোতেও বিভিন্ন সময়ে বিসিএসসহ পিএসসির বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে তাঁরা জড়িত ছিলেন।
সিআইডি বলছে, ৫ জুলাইয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় অন্তত ৫০ জন জড়িত। এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া ১৭ জনকে গতকাল কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
আরও পড়ুন
পিএসসির ভেতরে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্র
পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফর এর আগেও বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে সাংবিধানিক এই সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, একটি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পিএসসির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তাঁর অপরাধে জড়িত থাকার বিষয়টি বেশ কয়েক বছর আগেই জানানো হয়েছিল। এ কারণে তাঁকে কয়েকবার পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।
জাফর ঢাকার মালিবাগে একটি কোচিং সেন্টার চালান। এর নাম জ্যোতি কোচিং সেন্টার। এই কোচিং সেন্টারের আড়ালে প্রশ্নপত্র কেনাবেচার কাজ চলে বলে পিএসসির একাধিক সূত্র বলছে।
আরেক উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমও প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত, এটি পিএসসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবগত বলে জানা গেছে। যে কারণে গত ২ জানুয়ারি তাঁকে পিএসসি সচিবালয়ের (ঢাকার আগারগাঁওয়ে) প্রশাসন শাখা থেকে বদলি করে সিলেট আঞ্চলিক কার্যালয়ে পাঠানো হয়।
পিএসসির সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। মিরপুরে তাঁর একটি কোচিং সেন্টার রয়েছে।
আরও পড়ুন
পিএসসির ডেসপাচ (চিঠিপত্র আদান-প্রদান) শাখার কর্মচারী খলিলুর রহমান ৩৩তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ভুয়া প্রশ্নপত্র বিক্রি করেন। প্রশ্নপত্র বিক্রির সময় ২০১২ সালে হাতেনাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে তখন শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছিল। ২০১২ সালের ৭ অক্টোবর তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার তদন্ত করেন পিএসসির উপপরিচালক এস এম গিয়াস উদ্দীন। তদন্ত শেষে তিনি যে প্রতিবেদন জমা দেন, তাতে বলা হয় খলিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। পরে তাঁকে বিভাগীয় মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তখন তাঁর বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে নেয় পিএসসি।
পিএসসির একজন কর্মকর্তা বলেন, খলিলুর রহমান চাকরিতে ফিরে এলেও তাঁকে ভালো কোনো পদে দেওয়া হয়নি।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর বিরুদ্ধে প্রথমে মামলা হয়েছিল ২০১৪ সালে। ওই বছরের ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ‘সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার’ পদে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় এক পরীক্ষার্থীকে বাইরে থেকে চারটি লিখিত উত্তরপত্র সরবরাহ করার অভিযোগ উঠেছিল। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পায় পিএসসি। একই বছর তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। পরে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
পিএসসির তদন্তে উঠে এসেছে, সৈয়দ আবেদ আলী ভুয়া স্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সও নিয়েছেন। তদন্ত চলাকালে তিনি মাহতাব উদ্দিন নামের এক ব্যক্তিকে নিজের পিতা হিসেবে উল্লেখ করেন। যদিও তাঁর পিতার নাম আবদুর রহমান।
উপপরিচালককে দিয়েছিলেন ২ কোটি টাকা
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম জিজ্ঞাসাবাদে সিআইডির কর্মকর্তাদের বলেছেন, রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তিনি সংগ্রহ করেছেন উপপরিচালক মো. আবু জাফরের কাছ থেকে। এ জন্য আবু জাফরকে তিনি ২ কোটি টাকা দেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আরও বলেছেন, পিএসসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কক্ষের ট্রাংক খুলে তিনি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে সেগুলো টাকার বিনিময়ে ফাঁস করতেন। এর মধ্যে বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার (কোন বিসিএসের, সেটি জানা যায়নি) প্রশ্নপত্রও রয়েছে। এ কাজে পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী বিভিন্ন সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন বলে জানান সাজেদুল।
এদিকে রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন গতকাল নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তদন্তে পিএসসির একজন যুগ্ম সচিবকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পিএসসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে থাকে, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এমনকি আমারও যদি কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে, তাহলে আমিও শাস্তির বাইরে যাব না।’